আনোয়ার হোসেন আন্নু বিশেষ প্রতিনিধি
ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজারের বেশি শ্রমিক নিহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৯৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে কেটে গেছে ১২টি বছর। আজ বৃহস্পতিবার রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পূর্ণ হলো। কবে নাগাদ বিচারকাজ শেষ হতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেননি ঢাকার জেলা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. ইকবাল হোসেন।
এক যুগেও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রানা প্লাজা ধসের ভুক্তভোগী মাসুদা খাতুন। গত মঙ্গলবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচার পাওয়ার আশায় আমাদের এক যুগ কেটে গেল। কিন্তু বিচার পেলাম না। যাঁদের কারণে এত শ্রমিক খুন হলেন, তাঁদের কারও শাস্তি হলো না।’
পিপি ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সব সময় তৎপর। হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হবে।
মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ১৬৯ জন গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হন। ওই ঘটনায় মোট মামলা হয়েছিল ২০টি।এর মধ্যে তিনটি ফৌজদারি মামলা। শ্রমিক নিহতের ঘটনায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে পুলিশ। আর ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হত্যা মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন। অন্য দুটি মামলা ঢাকার আদালতে বিচারাধীন।
হত্যা মামলার বিচার শেষ হবে কবে?
সাক্ষ্য গ্রহণে দেরি হওয়ার বিষয়ে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আবুল কালাম খান প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের পিপি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পর মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা খুনের মামলার তদন্তে কেটে গেছে দুই বছর। মামলায় ছয় সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করতে আরও দেরি হয়। জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয় তখন বলেছিল, এ ঘটনায় যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত করতে কোনো অনুমতি দেবে না তারা। পরে অনুমোদন ছাড়াই ওই ছয় সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করে ২০১৬ সালে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর অভিযোগ গঠনের আদেশ হয় আরও এক বছর পর।
অভিযোগ গঠনের এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে মামলার সাত আসামি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তাঁদের পক্ষে বিচারকাজ স্থগিতাদেশের রায় আসে। এ কারণে পাঁচ বছর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল। পরে ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
add3
অভিযোগপত্রভুক্ত তিন আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমানে আসামি ৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে কেবল রানা প্লাজা ভবনের মালিক সোহেল রানা কারাগারে।
রানা প্লাজা ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরের বছর ২০১৬ সালের ১৪ জুন বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত। এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে মামলা করেন।
অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আবুল কালাম খান প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ আছে।
এর বাইরে ভবন নির্মাণের দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে আছে।
বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি প্রসঙ্গে শ্রমিকনেত্রী কল্পনা আক্তার মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজায় এক হাজারের বেশি শ্রমিক খুনের মামলায় সোহেল রানাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষের কাছে আছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে আন্তরিকতার ঘাটতি থাকায় এ মামলার বিচার শেষ হয়নি। এক যুগেও বিচার এগোয়নি।
কল্পনা আক্তার মনে করেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় যদি সোহেল রানাসহ অন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তাহলে অন্য পোশাক কারখানার মালিকেরা ভয় পেতেন। তাঁরা শ্রমিকদের জীবনকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি আশা করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিক হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার শেষ করতে উদ্যোগ নেবে। মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সাজা হবে।
0 comments: